বাংলা কবিতা, চিত্তরঞ্জন দাশ কবিতা, কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত - কবিতা অঞ্চল
কবিতাচিত্তরঞ্জন দাশ
কবিঅচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
4.2/5 - (17 votes)

যেই প্রাণ-মহানন্দ ছুটিয়াছে গ্রহ হতে তৃণের তরঙ্গে,
আগ্নেয় পর্বতোদ্গারে, বিহঙ্গে আর শার্দূলে, ভুজঙ্গে,
সূর্যের তূর্যের ছন্দে, উল্বাসিনী কল্লোলিনী-হিল্লোল-লীলায়,
নটিনী সে ঝটিকার উন্মত্ত নর্তনে, তারে তুমি বেঁধেছিলে
তোমার দুর্বল ক্ষীণ মৃণ্ময় দেহের প্রতি স্নায়ুতে শিরায়
ক্ষুদ্র এই আয়ুকুণ্ডে ; রক্তে রক্তে আবর্তিয়া তুমি তুলেছিলে
শক্তি-মুক্তধারা ! তাই শৃঙ্খলের আলিঙ্গন করি উল্লঙ্ঘন
কৃত্রিমেরে চূর্ণ করি’ বাহিরিয়া এলে হে সন্ন্যাসী বিবসন,
জ্বলন্ত জটার তলে গঙ্গার তরঙ্গ নিয়া এসেছিলে, শিব,
সে তরঙ্গ রঙ্গ ভঙ্গে মূর্ছাহত মৃত্তিকার নিষ্প্রভ নির্জীব
যত গুল্ম তৃণ-বত্স স্তন্য পিয়া’ স্কন্ধে তুলি’ প্রাণের পতাকা
করেছিল যাত্রা হায় দুর্ধর্ষ উদ্ধতভরে ; বীজের বলাকা
তব মুক্তি-বীজমন্ত্রে জন্ম লভি’ মৃত্তিকার গর্ভ দীর্ণ করি’
রৌদ্রের প্রসাদ পেল | তোমার দৃষ্টির ত্রাসে উঠিত শিহরি’
হে বব্ধনহীন বাত্যা, হে আদিত্য, যত মিথ্যা দৈত্য—কারাগার,
হে বিভঙ্গ, তবপক্ষ-সঞ্চালনে চূর্ণ যত পিঞ্জরের দ্বার ;—
কে তোমা রাখিবে রুধি ? রুধিরে বারিধি তব উন্মত্ত উধাও !
হে করাল, হে কালবৈশাখী, অবশেষে তাই তুমি ভেঙ্গে যাও
ভঙ্গুর দেহের কারা চিরমুক্তি-তীর্থমুখে, ওগো তীর্থম্ভূত !
মন্দার-সুগন্ধ নিয়া প্রাণানন্দে বন্ধহারা নন্দন-বিচ্যুত
এসেছিলে মর্ত্যভূমে ; হিমালয় হল তব নব পীঠস্থান
হে মহেন্র মানবেন্দ্র | প্রাণের আগুন জ্বালি তপ্ত লেলিহান
খাণ্ডব দাহন করি’ দানবেরে দলিয়াছ তাণ্ডবে তাণ্ডবে
জ্বলজ্জটা হে ধূর্জটি ! হে দুর্জয় শম্ভু, তব শঙ্খ-হাহারবে
জাগালে বাত্যা ও বন্যা | হে উদাত্ত উত্তাল বিশাল অম্বুনিধি,
কে মাপিবে অঙ্ক কষি তব ভাব-উচ্ছ্বসিত প্রাণের পরিধি,
শবের শ্মশানতলে তব নগ্ন তপস্যার কে বোঝে মহিমা ?
তুমি যে সমুদ্র রুদ্র, তাই লঙ্ঘি’ ক্ষুদ্র দিউ বদ্ধ তটনীমা
বিদীর্ণ বিকীর্ণ করি আপনাদের চতুর্দিকে বিচূর্ণ করিয়া
পরিপূর্ণ পান করি প্রাণের মদিরা, এলে তুমি উত্পাটিয়া
মহীদ্র ও মহীরুহ | হে বিদ্রোহী মেঘনাদ, হে নিত্য-জাগ্রত
আবার প্রশান্ত তুমি নিশান্তের স্নিগ্ধজ্যোতি আকাশের মত,
তোমার নয়নে জ্বলে শত সূর্য আর শত শতদল সৌরভ-মাধুর্যে,
বুকে মরুভূর জ্বালা, আর তৃণ-মঞ্জরীর শ্যামল প্রাচুর্যে
নিত্য নিত্য নব নব জন্মের উত্সব | তুমি কৃষ্ণ চক্রধারী
হনি অক্ষৌহিণী সেনা, আমার প্রেমের বেণু হে কবি, ফুকারী’
আনন্দের বৃন্দাবন করিলে সৃজন ; গীতার উদ্গাতা নব,
শিখাল ব্রহ্মণ্যতেজ অকর্মণ্যে, বহ্নিদীপ্ত রুদ্র অস্ত্র তব |
ভুজঙ্গেরা তব অঙ্গস্পর্শ লভি’ হয়েছে যে লবঙ্গ-লতিকা,
শৃঙ্খল হয়েছে স্বর্ণ, ধরা দেয় মায়াবিনী মরু-মরীচিকা
তোমার দৃষ্টির তলে ; ওগো ক্ষিপ্ত দৃপ্তজ্বালা দীপ্ত সর্বভূক,
ধূলায় নামিয়া আসি, হে সন্ন্যাসী, ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ, সেজেছ ভিক্ষুক,
কমণ্ডলু ভরিযাছ মুক্তি-তীর্থোদকে, করিয়াছ প্রাণ-ভিক্ষা
বজ্রেতে বোধন যার, কন্টক তপস্যা তীব্র, দুঃখ বহ্নি-দীক্ষা,
যে প্রাণ প্রহ্লাদ সম দূরন্ত আহ্লাদে নাচে উত্তপ্ত কটাহে,
তারে তুমি ডাক দিয়া ফিরিয়াছ পথে পথে অশ্রান্ত উত্সাহে
ভূষাহীন ওগো মুসাফের ! আহর্নিশি ওগো তাই তুমি ঋষি-রাজ,
মুক্তি চেয়েছিলে, তাই সঞ্চিত নিষ্ফল যত ঐশ্বর্য্যের লাজ
নিক্ষেপিয়া ঘৃণ্য আবর্জনা সম সেজেছিলে নগ্ন নিঃসম্বল
মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলি ;  তাতেও ছিল না তৃপ্তি, তাই অনর্গল
প্রাণের পবিত্র হবি রূদ্র মুক্তি যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দিয়াছ
দেহের বন্ধন টুটি’ চিরমুক্তিতীর্থ তুমি তাই লভিয়াছ |
এ আয়ুর আয়তনে কে তোমা’করিবে বন্দী, হে দুর্ধর্ষ বীর,
মৃত্যুতেও নাই নাই তোমার সমাপ্তি, কবি, তুমি যে অস্থির
সৃষ্টির যাত্রার ছন্দে মিশাইলে তব মত্ত নৃত্যের কিঙ্কিনী,
মৃত্যু-অমাবস্যা মাঝে বহাইলে বিদ্রোহের প্রাণ-প্রবাহিনী,
অজস্র অশ্রুর সাথে সহস্র আনন্দ ! তুমি বঙ্গের অঙ্গনে
আরম্ভিয়া গেলে যজ্ঞ, সেই অগ্নি উল্লম্ফিয়া উঠিছে গগনে
হেরিতে তোমার মুখে সর্বশেষ বিজয়ের নিঃশব্দ আহ্লাদ !
মৃত্যুতে, হে পুরোহিত, রেখে গেলে এই মন্ত্র, এই আশীর্ব্বাদ !

Share
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments