বাংলা কবিতা, হিংস্র যখন বারুদ আমার কবিতা, কবি কৌশিক মজুমদার শুভ - কবিতা অঞ্চল
কবিতাহিংস্র যখন বারুদ আমার
কবিকৌশিক মজুমদার শুভ
বিষয়রাজনৈতিক
লিখার স্থানখুলনা
লিখার সময়১১ জুলাই, ২০১৯
4.5/5 - (2 votes)

মর্সিয়া ওঠে বারুদ আমার, গর্জিয়া ওঠে ঝঞ্ঝা,
খুনের-পিয়াসী পিঞ্জর মোর, রক্তে রাঙিছে পাঞ্জা।

ইন্টোরোগেসন রুম, তখন উলঙ্গ বালবের নিচে থেঁতো হয়ে যেতো বামেদের হৃদযন্ত্র, তেঁতেঁ উঠতো স্নায়ু। ইদানীং ওসব শুনলেও মুর্ছা যায় পুলিশ, মুচকি হেসে মুচলেকা দ্যাখে জারজ।

-এনকাউন্টার, ঠায়! ঠায়! বিকৃত ঢঙে চেঁচায় রাইফেল, এখানে পড়ে যাওয়াই শিল্পসম্মত।
যখন পড়ে যাচ্ছিলো প্রাণ- আকন্ঠ রোদে উড়েছিলো বালি, যেমনি বারোটার শুকনো রোদে যুবকের কড়কড়ে কলার এসে বলে- একদিন এ এসেছিল, নেমছিলো, হেসেছিলো ফুটপাতে- একখানা নাগরিক জমায়েতে।
দেখেছিলো একখানি স্কার্ট উড়ে যায় বাতাসের হাঁচিতে, দেখেছে বারান্দায় অত্যুজ্জ্বল ক্ল্যাভিকল এক, অত্যুচ্চ-উচ্চকিত চঙ বেয়ে নামে, দ্যাখে রাস্তায় গলিতে অজস্র সেলাই দিদিমনি, হাঁটে-জটলা করে-ভেঙে পড়ে ফোটনের মতো, এ্যাখন– “থ্রি পিছ সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়”।
শিখেছে- রাস্তায়, মশারি এক মহামূল্য বস্তু, তোষক একটি দুরূহ ব্যাপার। যখন সে চোখ গেলে পৃথিবীর বাতাবরণে- শুনেছে দেশটা হয়ে যাচ্ছে নিউওয়ার্ক সিটি, আর বাদামী চুলের হ্যাঁদানো বুড়ো হয়ে যাচ্ছে কালোচুলো হড়হড়ে মাগী- তখন এই বাতাসে ড্রেনের পারফিউমে শুয়ে পড়েছে আয়েসী-হার্মলেস রাত।
তার হয়ে আমি, সহসা দেখি- ডাউনমার্কেট হকারে ছেয়ে যায় আপলেভেল শহর, বিলাসীন ফুটপাত নুয়ে যায় হরদম ঠেলায়, শ্রেণীবিবাদের ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ে- তবু নৌকার ছলে, ছায়াতল এসে পড়ে হামেশা- তখন ইনসেক্টিসাউড মেরে উচ্ছেদ করে সব রাতারাতি- নির্মল শহর।
-“তোমাদের এই ঝলমল শহর, পীড়াহীন রাত্রি নেবে আসে, সারসার জ্বলে মরিচবাতি-আলোকসজ্জ্বা, দরদরে ঘামে শ্যাম্পেন খুলে যায়, আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। এইখানে একদিন রাস্তায় দমেদমে লাইন ছিলো, পত্রিকা ছিলো, শারীরিক অভিযান ছিলো- তবু পরিছন্নতা এসে পড়ে, টিপটপ ভদ্দরলোকি বেশে- বেশ্যার সব দাগ ধুয়েমুছে নিয়ে যায়”।

যখন হরতাল নাবে, জিহবায় টেনে ধরে- ছঁড়ে যায়, ‘জ’ বলতে পারে না ‘ল’ বলতে পারে না, ‘জালিয়াত’ বলতে পারে না, বানচোত’কে বানচোত বলতে পারে না। বাজার বন্ধ থাকে না, তবু আয়ু বেড়ে যায় ব্রয়লার মুরগীর, প্যাঁকপ্যাঁকে মিথ্যাবাদি হাসঁ বেঁচে যায়, বেড়ে ওঠে- বুড়িগঙায় দ্যাখে টেমস অথবা নাইল ।
-“আঙুলের নখে খাঁমচে ধরতে পারিস না! বানচোদের গলার ডিম?”

‘কৈফিয়ত’- ঘষটা গোড়ালী, চ্যাঁড়চেঁড়ে হাঁড়, কাটা রগ, চিঁড়চিঁড়ে চিঁড় ধরে গায়ে। ওঠ চুলকাই, নাক চুলকাই, বারান্দায় বুড়ো আঙুল দিয়ে কুঁচকির ভাঁজে চুলকাই; স্বাধীনতা চুলকানোর- সুযোগে মাথা চুলকাই- বাজেট পড়ি, দেখি, মুখস্থ করি- ন্যাপথার মতো উবে যায় বেমালুম হচকিত মস্তিষ্ক। তবু হৃদয়ের পাশে যে বলেছিলো, কানের কাছে– এ দেশ হবে ভাঙা বোতলের মতো মানুষের, যারা বোতলের মতো ল্যাঁদ খায় রাস্তায়। তবে বেলাশ্যাষ বিমান চড়ে টাকা, উড়ে যায় ম্লেচ্ছের দেশে, আমলার ভাংতি প্রজেক্টে লুট হয় ব্যাংক ও ব্যাঙ-কক। অন্য ফ্লাইট ধরে উড়ে আসেন কাঁচিহাতে সার্জন।
মিটিং-মিছিল-সমাবেশে কাকের ঠোঁটে চেটে খায় ঘাম, আমি বিচ্ছিন্ন হই, ফেটে পড়ি- আবার সপ্তাহশেষ, ফের আসে শনিবার। যখন দেখি বাবা হয়ে যান হতচকিত, মায় চলে না মদের ঠেকে- আমার ঘামে ভিজে আসে কলার। রাস্তায় নামি, দেখি ফুটপাতে হেঁটে যায় কিশোর-কিশোরীর লাশ, হ্যাঁক হ্যাঁক হ্যাটকায় জান্তব জারজ। আমি দেখি মজা নিই, জানি পরের ট্রেনে এসে যাবে আমার ভাইয়ের ‘প্রিয় লাশ’।
সন্ধ্যায় পানশালা ঘুরে আসি-পত্রিকা পড়ি- দেখি যে জীবন মানুষের- টাওয়ার থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আধপোড়া লাশ, আমি হ্যাঁট-হ্যাঁট হ্যাটকাই। জানি, দিনশেষে পাওয়া যাবে ‘মুফত মে ইয়াবা’। রোজ যাই সিটি ইন’এর পাশ দিয়ে, দেখি অজস্র ব্যক্তিগত গাড়ি ও নারী বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে; দেখি-ভালো লাগে! হাঁটি আবার দেখি। পকেট হাতড়াই, ঠান্ডা বেজায়- খালি খালি লাগে।
শেষমেশ বেডরুমে ফিরে আসি- টিভি খুলে, কেউ মুখ খুলে দেখায় লাল-রোম টাকরা, শাপলা-চোর-হাঁস বউদি হাসে- টানটোন দেয়- টাঁটিয়ে যায় টাট্টুঘোড়া- শামুকের টেন্টাকলের মতো বের হয়ে আসে। ইসবার ব্রেকিং নিউজ- “কলে পানি আসে প্রতিদিন”, “ঘুম জাগানিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র”, “কয়লায় দাঁত মাজা সহজ”, “হাসলে যকৃতের চাপ কমবে”। অতঃপর-
স্টপিজ এলে নেমে যায় অজস্র ফুল- গন্ধে লালা ঝরে কত সিম্ফনিক শকুনের, শুনি রোজ বিষ্যুদবার এলে মরে যায় কিছু সনদপ্রাপ্ত গোলাপ- বার্ণ ইউনিট এলে পাঁজর খাঁমচে ধরে বিব্রত শকুন, বুকের ফাটলে ব্যাথা চিনচিনায়- বেড়ে ওঠে, হামাগুড়ি দিতে চায়। আমি হাসি, বলি- মানুষ দু’বার জন্মালে একবার বাঁচে। “একজন বলেন ধর্ষণ এখন সবদেশে হয়; ট্রেন্ড- কেউ বলবে ঐতিহ্য”।
এইসব, এমন রাত্রিগুলো নিরবে নামে- রোজ আসে, বেলাশেষে- বিষণ্ণ রোববার। পৃথিবী পিস্টন আর ঘর্ষণের উৎসবে বাঁচে, আমি শুয়ে থাকি, জুস টানি স্ট্রতে- রাত হলে গর্ত থেকে বেরোই; কবিদের মতো; আজকাল নিজেকে বড়ো ইঁদুরের মতো মনে হয়; ঈ তে ঈঁদুর।

Share
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments