কবিতাশাপভ্রষ্ট
কবিবুদ্ধদেব বসু
4/5 - (1 vote)

যৌবনের উচ্ছ্বসিত সিন্ধুতটভূমে
বসে আছি আমি ।
দগ্ধ স্বর্ণ-রেণু-সম বালুকণারাশি
লুটায় চরণ-প্রান্তে অকৃপণ বিপুল বৈভবে ।
ঊর্দ্ধে মম রক্তিম আকাশ—
প্রভাত-সূর্যের লজ্জা রঞ্জিত করিছে অরণ্যানী ।
সদ্য-নিদ্রা-জাগরিত গগনের পাণ্ডুভাল-’ পরে
বহ্নি-শিখা করিছে অর্পণ :
কামনার বহ্নি সে যে, স্বপনের সলজ্জ বিকাশ ।
গোলাপের বর্ণে-বর্ণে স্বপ্ন-সুধা মাখা,
আরক্তিম কামনায় আঁকা ।
আমার অন্তর নিয়ে একাকী বসিয়া আছি আমি
উচ্ছ্বসিত যৌবনের সিন্ধুতীরে ।

সম্মুখে গরজে সিন্ধু বেদনার দুঃসহ পীড়নে ।
লক্ষ-লক্ষ লুব্ধ ওষ্ঠ মেলি’
চুম্বিয়া মুছিতে চাহে গগনের তরুণ রক্তিমা,
রিক্ত করি’ দিতে চাহে ধরিত্রীর তীর্থযাত্রীদলে
সহসা-বন্যায় ।
নিষ্ফল আক্রোশে তার ক্রূর জিহ্বা উদ্ গারিছে বিষ,
তরঙ্গ-মথিত ফেনা রেখে যায় সৈকত-শিয়রে ।
গাঢ়কৃষ্ণ জলরাশি অস্বচ্ছ অতল
নিত্য-নব অমঙ্গলে করে জন্মদান
গোপন গভীর গর্ভে ;
অকল্যাণ বায়ু বহি’ প্রাণের মন্দিরে
নির্বাপিত করি’ দেয় পূজার প্রদীপ ;
ম্লানমুখে ঝরি’ পড়ে কাননে অষ্ফুট শেফালিকা
হিমস্পর্শে  তার ।
আমি শুষ্ক, নিশাচর, অন্ধকারে মোর সিংহাসন ।
আমি হিংস্র, দুরন্ত, পাশব ।
সুন্দর ফিরিয়া যায় অপমানে, অসহ্য লজ্জায়
হেরি মোর রুদ্ধদ্বার, অন্ধকার মন্দির-প্রাঙ্গণ ।
সুদূর কুসুম-গন্ধে তার যাত্রা-বাঁশি বেজে ওঠে ;
দৈন্য-ভরা গৃহ মোর শূন্যতায় করে হাহাকার ।
—-যৌবন আমার অভিশাপ ।
ক্ষণে ক্ষণে তরঙ্গের ‘পরে
গগনের স্নিগ্ধ শান্ত আলোখানি বিচ্ছুরিত হয়ে যেন লাগে ;
ফুটে ওঠে সোনার কমল
ক্ষণিক সৌরভে তার নিখিলের করিয়া বিহ্বল ।
সেই পদ্মগব্ধখানি এনে দেয় মোর পরিচয়
পল্লব-সম্পুটে ।
বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে পড়ি আমি লিখন তাহার :
‘হে তরুণ, দস্যু নহ, পশু নহ, নহ তুচ্ছ কাট—
শাপভ্রষ্ট দেব তুমি ।’

শাপভ্রষ্ট দেব আমি !
আমার নয়ন তাই বন্দী যুগ-বিহঙ্গের মতো
দেহের বন্ধন ছিঁড়ি শূন্যতায় উড়ি’ যেতে চায়
আকন্ঠ করিতে পান আকাশের উদার নীলিমা ।
তাই মোর দুই কর্ণে অরণ্যের পল্লবমর্মর
প্রেম-গুঞ্জনের মত কী অমৃত ঢালে মর্ম-মাঝে ।
রবির গভীর স্নেহে, শিশিরের শীতল প্রণয়ে
শুষ্ক শাখে তাই ফোটে ফুল,
দক্ষিণ-পবন তারে মৃদুহাস্যে আন্দোলিয়া যায় ।
রাত্রির রাজ্ঞীর বেশে পূর্ণচন্দ্র কভু দেয় দেখা,
আঁধারের অশ্রুকণা তারার মণিকা হয়ে জ্বলে
ত্রিযামার জাগরণ-তলে ।
স্তব্ধচিত্তে চেয়ে থাকি ; অন্তরের নিরুদ্ধ বেদনা
সযত্নে সাজাই নিত্য উত্সবের প্রদীপের মতো
আনন্দের মন্দির-সোপানে ।
সুধায় নির্মিত মোর দেহ-সৌধখানি,
ইন্দ্রিয় তাহার বাতায়ন—
মুক্ত করি’ রাখি’ তারে আকাশের অকূল আলোকে
অন্ধকার-অন্তরালে অন্তরের মাঝে
বিনিঃশেষে করি যে গ্রহণ !

অক্ষম, দুর্বল আমি নিঃসম্বল নীলাম্বর-তলে,
ভঙ্গুর হৃদয়ে মম বিজড়িত সহস্র পঙ্গুতা—
জীবনের দীর্ঘ পথে করেছিনু কোন্
                       স্বর্ণরেখাদীপ্ত ঊষাকালে—
আজ তার নাহিকো আভাস ।
আজ আমি ক্লান্ত হয়ে পথ-প্রান্তে পড়ে আছি
                       নীরব ব্যথায় শান্তমুখে
ঝ’রে-পড়া বকুলের গন্ধস্নিগ্ধ বিজন বিপিনে ।
সেই মোর গোধূলির সুরভি আঁধারে
যার সাথে দেখা,
যার সাথে সঙ্গোপনে প্রণয়-গুঞ্জন,
যার স্পর্শে ক্ষণে-ক্ষণে হৃদয়ের বেদনার মেঘে
চমকিয়া থেলি’ যায় হর্ষের বিজলী ;—-
নেত্রের মুকুরে তার দেখেছি আপন প্রতিচ্ছবি,
দেখিয়াছি দিনে দিনে, ক্ষণে-ক্ষণে আপনার ছায়া,
দেখিয়াছি কান্তি মম দেবতার মতো অপরূপ,
ভাস্করের মতো জ্যোতির্ময় ;—-
তখন বিষণ্ণ বায়ু নিঃশ্বসি’ কহিয়া গেছে কানে :
‘শাপভ্রষ্ট দেব তুমি !’
নিকুঞ্জের সঙ্গী মোর হাসিয়া কয়েছে যবে কথা
তুচ্ছতম বাণী তার রূপান্তর করেছে গ্রহণ,
বিহঙ্গের উদাসীন কলকন্ঠ-সাথে মিশি’ আসি’
বেজেছে আমার বক্ষে দুরাশার মতো—
‘শাপভ্রষ্ট দেব তুমি !’
তাই আজ ভাবি মনে মনে—
পঙ্কের-কলঙ্ক-বারি উত্তরিয়া আছে মোর স্থান
পঙ্কজের শুভ্র অঙ্কে ।
শেফালি সৌরভ আমি, রাত্রির নিঃশ্বাস,
ভোরের ভৈরবী ।
সংসারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কন্টকের তুচ্ছ উত্পীড়ণ
হাস্যমুখে উপেক্ষিয়া চলি ।
যেথা যত বিপুল বেদনা,
যেথা যত আনন্দের মহান্ মহিমা—
আমার হৃদয়ে তার নব-নব হয়েছে প্রকাশ ।
বকুল-বীথির ছায়ে গোধূলির অস্পষ্ট মায়ায়
অমাবস্যা-পূর্ণিমার পরিণয়ে আমি পুরোহিত ।–
শাপভ্রষ্ট দেবশিশু আমি !

Share
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments