কবিতামাহাতদের মরা শিশু
কবিমণীন্দ্র গুপ্ত
বিষয়জীবনমুখী
4/5 - (3 votes)

কবরে শোয়া শিশুর মুখের উপর শেয়াল এসে আঁচড়াচ্ছে—
মরা শরীরে তত সাড় নেই, তাই শিশু ভাবছে, বুঝি মায়ের আদর।
তারপর যখন গলার নলী কামড়ে তাকে টেনে তুলল উপরে,
মাটি লেপা চোখে তেমন দৃষ্টি নেই বলে শিশু ভাবছে, মা বুঝি
টেনে নিল।
এই সময় আমারও স্বপ্ন ভাঙল—
এইরকম ঘুম ভাঙলে পাশে হাত বাড়িয়ে কাউকে না পেলে
কী হয় তুমি জান: যেমন নিশি এসে ডাকলে
একডাকে চলে যেতে হয় তেমনি আমি দরজা খুলে বেরোলাম।
কুলুঙ্গিতে বসে থাকা পুরোনো টাইমপিস ঘড়িটা ঘাড় কাত করে
সারা দিন বসন্তবৌরির মতো ডাকে।
নিশির ডাকে তারও দুই পাশে হঠাৎ পাখনা গজাল, সেও
একটা ঝাপটা দিয়ে উড়ে আমার সঙ্গে বাইরে এল।
এতদিন পরে আমার সময় শেষ হয়েছে তাই ঘড়িরও সময় শেষ।
এখন আমরা দুই পথিক স্যাঙাৎ— দুই রগুড়ে— দুই ট্যাটন—
আমি বাঁশের লাঠি কাঁধে ফেলে আকাশপথে হাঁটি,
সে তার ভিতরের কলকবজা ফেলে দিয়ে, দুই কাঁটার গোঁফে চাড়া দিয়ে
যেতে যেতে বলে ‘তামাম শোধ’।
কিন্তু অনন্ত থেকে আমাদের চুম্বকের মতো টেনে আনল
মাহাতদের মরা শিশুরা।
মহুয়া গাছের ছায়ায়, গোরু মোষের চলার পথে
তাদের কবর দিয়ে রাখা হয়েছে।
সেখানে এলে দুধেল গাভীদের বাঁট ঝুলে পড়ে,
শিশুদের ঠোঁট যেন তাদের চুচুক আঁকড়ে ধরেছে—
শরীরের টান, মনের টান, নাড়ীর টান— এখানে কেবল কষ্ট কষ্ট
আর কষ্ট।
পেটে বাচ্চা নিয়ে যে মারা গেছে, এই রাতে সে পাগলিনীর মতো খুঁজে খুঁজে
এসেছে ভ্রূণের গোরের কাছে। তারা মা-ব্যাটা এই গনগনির মাঠে
দুজনার একটা ডাকাতের দল খুলবে— পথিককে ভুলিয়ে এনে
ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলবে!
কিন্তু ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় দেখা যায়, সেই ভূত একলা
ভিখারিনীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
এদিকে শেয়ালনী ছোট্ট মাথাটিকে দুই পায়ের মধ্যে রেখে
কাঁকড়া খাবার মতো করে এক কামড়ে ভেঙে দিলে
বাচ্চাটা ককিয়ে উঠল: মা!
শেয়ালনী করুণ স্বরে ‘বাছা, এই তো আমি— ’ বলে
ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে খেতে লাগল।

Share
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments