<সে বড় উল্টো পথ
সে বড় কষ্টের পথ
তবু কিছু লোক ছিল তখনও
তবু কিছু লোক আছে এখনও
তারা স্রোতের উল্টো পথে
দাঁড় বাইতে বাইতে উজান ভাঙে
তারা স্রোতের উজানে
পথ ভাঙতে ভাঙতে
নতুন করে গড়ে দেয় পথ>
–উজানগাথা
ভোরবেলায় খুউব ভোরবেলায়
ওরা বড় রাস্তা পার হয়ে
বিদ্যাপীঠ ইস্কুলের পিছনে পুকুরপাড়ে
আমিন সাহেবের ঘরের ওদিকে
যাচ্ছিল দলবেঁধে
পরনে লুঙ্গি গায়ে সাদা আলখাল্লা
মাথায় ফেজ টুপি
আমাদের পাড়ার পুরোনো মসজিদের
মৌলভিরা,
আমি ভোরবেলায় হাঁটতে বেরিয়ে
থমকে দাঁড়িয়ে শুধোলাম,
বললেন, ‘চলে গেছেন কাল রাতে
আমরা যাচ্ছি দেখতে
শেষ দেখা দেখতে’
আমিন সাহেবের বড় ছেলে
মুদি দোকানী মণি আমাকে দেখে
হাত ধরে ডেকে নিয়ে গেল ঘরে
ঘর বলতে টালির খাপরার
দু’কুঠরির মাটির ঘর
সামনে এক চিলতে উঠান
সেখানে বাড়ির মেয়ে বউরা
জটলা পাকিয়ে গপ্পো করছে
‘কেমন মরণ দেখো
এমন মরণ কেউ কখনো দেখে নাই
মরণ সময় ছেলেদের ডেকে শুধালে,
আমার কবরখানা তয়ার করেছিস
আমার কবরখানা ‘
সামনের ঘরে মাটিতে শোয়ানো
তাঁর মরদেহ
সেখানে ভীড় জমিয়ে মৌলভী সাহেবরা
আমি দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে
মণি বললে, ‘চলুন দাদা ঘরে চলুন’
ঘরে ঢুকে ভিড়ের ফাঁকে
তাঁর মুখখানার দিকে তাকাতেই
প্রসন্ন মুখে বারে বারে ঘুরে ফিরে
তাঁর সেই কথাগুলোই যেন
শুনতে পেলাম আবার
‘মালিক আমাকে ভালো রেখেছেন
মাস্টারবাবু
ভালো রেখেছেন খুব
আমার রোগ নাই বালাই নাই কিছুই নাই
আল্লার দোয়ায় এই বয়সে যা আছি
ভালোই আছি’
আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম অপার বিস্ময়ে
একদিন কথায় কথায় শুধিয়েছিলাম তাঁকে,
‘শিশু বিদ্যাপীঠের ইসকুলের জন্যে
আপনি যে জমি দিয়েছেন বিনাপয়সায়
এই বাজারে তার দাম তো ছাড়িয়ে যেত
কোটি টাকা
আপনার ছেলেরা রাগারাগি করে বলে,
বাবা’র নামটুকু পর্যন্ত রাখলো না কোথাও ইসকুল কমিটি
তা এতটা জমি কেন দিয়েছিলেন লিখে?’
আমার প্রশ্নের মুখে একমুখ হাসি হেসে
তিনি বলেছিলেন, ‘সে আর কী বলি বলুন তো
মাস্টারবাবু?
আমাদের এখানকার মান্যিগন্যি বাবুরা
সবাই যেভাবে হাতে ধরে বললেন
আমাকে
আমি ফেলতে পারলাম না তেনাদের কথা
যাই বলুন আর তাই বলুন
আমি তো আর আপনাদের মতন
লেখাপড়া জানা মানুষ নই
আমি মুখখু সুখখু মানুষ
তাই বাবুরা আমার নামটা না দিয়ে
যা করেছেন ভালোই করেছেন
আর জমির কথা যা বলছেন
ছেলেরা এখন ওই নিয়ে উঠতে বসতে
খোঁটা দেয় আমাকে
সে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে আমার
আপনাকে তাহলে মোদ্দা কথাটা
খুলেই বলি শুনুন
জমিটা এখন বিচলে এক কাঁড়ি টাকার
মুখ দেখতে পেতাম সে আমি জানি
কিন্তু আপনি বলুন দেখনি মাস্টারবাবু
এই যে রোজ সকালে আমার ঘর দুয়ারে
পিঠে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে
কত নিত্যনতুন কচি কাঁচার মুখ দেখি
আলো ঝলমল মুখ দেখি
সে কী কম জিনিস বলুন আপনি
এক কাঁড়ি টাকার চেয়ে সে অনেক দামী
সে অনেক দামী’।
কবি সুবীর মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে