এত আয়োজন—
আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন মতো ছিল মেয়েটার কাছে।
বারো হাত সমান দু’-দু’টি কাপড় নিয়ে
নারায়ণ মশাই উঠানে হাজির।
একটা তার লাল পাড়ে সবুজ;
আরেকটা টুকটুকে নীল।
এ’তো গেলো মঙ্গলাচরণ, পরের দিন যে বিয়ে!
এত আয়োজন—
কোঁড়া পাখির বাঁধা ছোট্ট খড়কুটোর ঘরের আনন্দের চেয়েও
বিশাল ছিল মেয়েটার কাছে।
বিকেল বেলা হকার এলো;
কমলা, বেগুনী, লাল-হলুদে মিশে সে কী চুড়ির বাহার!
শ্রীদেবীর আঁচলের গিঁটে বিশ টাকার এক জীর্ণ-শীর্ণ নোট,
বহুদিন পর তার ঠোঁটে মুক্ত হাসি;
চোখ জুড়ে তার আনন্দ মিছিল!
এত আয়োজন—
মরা ডুবায় ভেসে থাকা কচুরিপানাদের সুখানুভবকেও
হার মানিয়েছিল মেয়েটার মনে।
মেয়েটার গালে হলুদ ছোঁয়া;
মেয়েটার গায়ে লাল পাড়ে সবুজ শাড়ি।
মাথা গড়িয়ে জল বেয়ে পড়ার অপরূপ দৃশ্যে,
প্রণয়িনীরূপী এক সাধারণ নারী।
আহা শুভ দিন, আহা আয়োজন!
এত আয়োজন, এত মানব সমাগমে—
কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর অনুরঁজনের চেয়েও
সাতিশয় বোধ করেছিল মেয়েটা।
আজ অমাবস্যা; আজ জোনাকির বিয়ে।
এঁদো আকাশে পঁচিশখানা ঝঁঝা
উড়িয়ে বরযাত্রী সম্ভাষণ করেছে পাড়ার ছেলেরা।
এত আয়োজন—
পলিথিনে বেঁধে দেয়া নারিকেল শোলার
ঘুড়ি উড়ানোর প্রমোদটুকুকেও হারাতে যাচ্ছিল।
কিন্তু,
বয়ে যায় লগ্ন, জোনাকি তখন নগ্ন।
খোঁপায় শ্রী পিসিমনির গুঁজে দেয়া
বকুল ফুলের মালা থেঁতলে গেছে!
নারায়ণ জ্যেঠুর আনা নীল শাড়িটার
গায়ে গোটা কয়েক ছিঁড়ে-ফাঁড়া;
কপালে এঁকে দেয়া তিলক ফোঁটা ছিন্নভিন্ন!
দুধ-সাদা শরীরটার সবটুকু সহ্যশক্তি
সহ্যক্ষমতার শেষ পর্যায়ে।
ঠাকুর মশাই যজ্ঞ মঞ্চে জল ঢেলে অনল নিভালেন,
সন্ধিক্ষণ থমথমে।
‘যদিদং হৃদয়ং মম তদিদং হৃদয়ং তব’ মন্ত্রে
মুখরিত হয়ে উঠল না আর চারপাশ।
পড়ে রইল মেয়েটার বিশ্রদ্ধ দেহ,
আর এক খন্ড বিবর্তিত ধ্বংসস্তুপ।
মা-বাপ হারা মেয়েটা মান সম্মানের ঘানি টানার
প্রতিযোগিতা হেরে গিয়েছিল সেদিন।
পরের দিন সূর্যোদয়ে জটলা বেঁধেছিল
চক্কুত্তি মশাইয়ের বাড়ির কাছের বটগাছখানা ঘিরে।
গাছে বাঁধা ছিঁড়া-ফাঁড়া নীল শাড়ি;
শাড়ির এক মাথায় ঝুলে আছে মেয়েটা।
এত আয়োজন—
আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন মতো ছিল মেয়েটার কাছে।
আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর
আধস্বপ্ন মনে থাকার মতোই
অপূর্ণ রয়ে গেলো আয়োজনের সার্থকতা।
জোনাকির জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠার সাধ
আর পূরণ হলো না!
এই কবিতাটা হৃদয়ে আঘাত করল।