সেদিনের সেই বিকেল আজও ঘ্রানফুলের এক মাদুলি উপহার দেয়,যখন জখমের চিহ্ন দুপুরের রোদ হয়ে ভেসে বেড়িয়েছে নিশ্চুপ রাতের তারাদের মত চিঠি উড়ে গেছে ঘুড়ির নাটাইয়ের বা পালংকের পাশে থাকা ঝুল দোলনার কাছে।কান্নার হিসেব মেলে নি ক্ষত জমেছে পাহাড় প্রমাণ, সত্য বলছি! সবাই আমাকে সত্যেন নামে ডাকে,পাড়ার সবার খুব ইচ্ছে আমি ডাক্তার হব।হাতের কাজ গুটিয়ে নিয়ে লাইব্রেরি বরাবর যে সুন্দর ছেলেটি হেটে চলেছে ক্যাম্পাসের হিরো সে তার নাম অতুল, আমাদের সব কিছু খুব ভালো চলছিল,কেউ ডাক্তার হব আবার কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আজ সবাই দর্শনের ছাত্র হয়ে দিন রাত উর্দু ঠেকাও, বাংলা জিতাও আন্দোলনের শিক্ষক মিনার চৌধুরী’র দিন রাত্র সুরেলা গলার বকুনি খাচ্ছি।চায়ের দোকানে ভীড় বাড়ছে,আমি,অতুল ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বাদাম ভাজা খাচ্ছি,পকেটে টাকা নাই।হঠাৎ রেডিওতে উর্দু গজল ভেসে এলো সেই থেকে সবার রাগ। তারপরই এক ঘোষনা মুস্তাফিজুর রহমানকে ধরিয়ে দিতে হবে দিলেই পাঁচ লক্ষ টাকা দেয়া হবে।বাদাম চিবুই আর আমি ভাবি সত্যিই কি সত্য পারবে একটা একাত্তরের দামাল ছেলে হতে?অতুলের আর কি ও পিহুকে না পেলে কিছুই হবে না তার জীবনে।কিছুক্ষণ আগেই কিছু পাকিস্তানি মিলিটারি মার্চ করতে করতে বাম দিকে চলে গেল।আমি বাদাম চিবুই আর অতুল তখন চায়ের কাপে চুমুক দেয়।চুমুক দেয়ার চা আর ধোঁয়া তোলা চা আমাকে ভিন্নমত স্বাদ দেয় অই দিকে কার্জন হলের ফুটপাত পাড় হচ্ছে যেই বেনী করা তাতে কাঠফুল গোজা চোখে কাজলতোলা এক ছিপছিপে রমনী সেই হচ্ছে আমাদের পিহু ও সাইকোলজির স্টুডেন্ট! একজন সেনার চোখ পড়লো তার দিকে! আজব করে সবাইকে সেই সেনা তার সামনে এগিয়ে গেলে সে হাতে গুজে দিল একটি চিঠি!
“তাবেদারের দল,শোন,
আমরা অনেক সয়েছি আর সইবো না।আমাদের রক্তের দাম দিয়ে যাবি,নাহলে দাবি থাকলো নিস্তার পাবি না।”
আমি চমকে উঠলাম ক্যাম্পাস পাড়া থমকে গেল।কি অসীম সাহস তার,ভাবতেই ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো।
অতুল পিহু আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরলো।লক্ষী সোনাটি আমার তোমাকে কিছু করে নি তো ওরা? পিহু হাসতে হাসতে তখন তার পাশে বসে গেল।
“আরে,আমার ক্যাম্পাস,আমাদের ক্যাম্পাস কে আমাকে কি করে আবার!” ঠিক তখনি সেই সেনাটি এসে হাজির আমাদের সামনে। রাগে লাল হয়ে আছে তার চোখ।হাতে তার দুমড়ানো মোচড়ানো সেই চিঠি। অতুল দৌড়ে গেল,
“ কুছ হুয়া কিয়া সাহেব? ছোটি হ্যায় না,কুছ ভি নেহি আতি ইসকো।কুছ কিয়া হে তো মাফি চাহাতা হু।”
“ দেখে তো সাহি কিতনি ছোটি হ্যা!”
কটমট করে সেই সেনা এবার পিহু’র হাত ধরে টেনে হিচরে হাকিম চত্বরে নিয়ে গেল। পিছনে ছুটলাম আমি আর অতুল।ধুলার রাস্তা দামি হল, পিহুর সস্তা হল শাড়ি, সেই শাড়িটি টানছে ধরে ষোল সেনা পাকিস্তানি, একটি করে ভাজ খোলে তার বলে উঠে “ জয় বাংলা” সবাই তাকিয়ে আহাজারি দেখে আর বলে, মা, তুই থাম এরা বোঝে না বাংলা! পিহু অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে বলে ওদের জ য় বাংলা শিখিয়ে আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাই করেছে স্বাধীন বাংলা।শেষ দুটি ভাজ বাকি থাকতে ই যেই না সেনা দল ছুড়লো বুলেট,অতুল মৃতপ্রায় হয়ে আর আমি চিৎকার করে বলছি, “ বাংলা মা তোমায় স্যালুট!” পিহু তখন আর্তনাদে বাতাস করেছে ভারী তবু বলে নি পাকিস্তানি জিন্দাবাদী।লাল রক্তে ভরেছে আমার হাকিম চত্বরের সেই রাস্তা, মানুষ কেঁদে সেনাদের বলে, “ লাশ দেনা হাম লোগো কো তুমহে আল্লাহ কি ওয়াস্তা।” লাশ নিয়ে হবে সংগ্রাম হবে মিটিং মিছিল এই ভেবে তারা নিয়ে গেল লাশ, ১৩ ই ডিসেম্বর ছিল সেদিন।উজার করে দেব তোমায় ভালোবাসার রং বলতো যেই অতুল সেই মানুষের কাঁধে দিল পিহু’র লাশ সেনা দল।এবার আমি, অতুল, সেনাদল চললাম গাড়ি করে গুলশান,সেখানে তার দাদির কবর,তার শেষ অনুরোধের তিরোধান,গতকাল রাতেই নাকি বলছিল এই মেয়ে ভালোবেসে কবর দিও দাদির ঠিক পাশে।দুষ্টু মেয়েটা দুষ্টুমির ছিল শিরোমনী অতুল তাই হেসেছিল ভাবে নি আজ ই হবে সেই কাহিনি। অতুল সেনার কানে কানে কি যেন বলেছিল তাই তারা রাজি হল আর গুলশানে ঠিক ই লাশ নিল।বুকের পাঁজরে লেখা নাম নিয়ে ভালোবেসে সে দিল দাফন তার লাশ।আযান দিলাম আমি সত্যেন নাম হল হাফিজ আমার।হিন্দু ছেলে দাফন দিল আমি দিলাম আযান। হিন্দু বলে,পিহু’র পাশের কবরে স্থান পেল অতুল আমার।কুরানে হাফেজ এগিয়ে এলো, “ হিন্দু সৎকার দাও।” অতুল বলল,” ভালোবাসি দেশ,ধর্ম দেশের কাজ তবু ভালোবাসা তার তাজ”। দুটি গুলিতে শেষ দৃশ্য কেউ না জানে আজও হাফেজ হয়ে সত্যেন বাঁচে,জানে নি সত্য কেউ এখনো ।হঠাৎ সেদিন আমার লেখা উর্দু শায়েরি পড়ে বলছিল বেশ খাসা কবি তুমি কেমন করে শায়ের হলে?কেঁদে আমি বলেছিলাম আমি সত্যেন আজ হাফেজ ভাই আমার মত কত বাঙালী হয়েছে জানি না দেশের আযান।আমি আজ গজল লিখি,লিখি শায়েরি তবে কি জানো পিহু’র মুখের ভাষা হয় নি গায়েব আজও। এখনো আমি ঘুমের ঘোরে “ জয় বাংলা ” শুনতে পাই। প্রতিদিন আমি আযান শুনলে হরি কীর্তন গাই।ইতিহাস খুঁজে আমায় তুমি এনে দাও এমন এক কাহিনি যার কাছে মানুষ বড় ধর্ম জায়গা রাখে নি।আজকের আমি লেখক হয়েছি এটাই আমার পেশা, কলমে কলমে যুদ্ধ করা হয়েছে এক নেশা।সত্যেন আমি সত্য বলি মিথ্যা ওদের ছায়া, কসম খোদার আরেকবার এই কাহিনি হলে বলে ছাড়ব “ জয় বাংলা”।
2023-09-04