বাংলা কবিতা, আইসোলেশন কবিতা, কবি মার্সেলিন কুইয়া - কবিতা অঞ্চল
4/5 - (1 vote)

আমি অপর্ণা সেন।
বাবা মৃণাল সেন।
আমি দুই নাম্বার গেইটে ছ’তলার বিল্ডিংটার চারতলায় একটা রুমে আইসোলেটেড থাকি।

আপনারা শুনুন, আমি করোনা পজেটিভ।
করোনা পজেটিভ আমার বাবাও!
আপনারা মায়ের কথা ভাবছেন, জানি!
মা বেঁচে নেই।
মারা গেলো দুই হপ্তাহ আগেই…
এর ষোল ঘন্টা আগে-
আমার দাদী!!!

আমি, অপর্ণা সেন দু’দিন পর থেকেই আইসোলেশনে থাকি।

মা যেদিন মারা গেলো, আমি সেদিন মেডিকেলেই!!!
আমার হাতের উপরই গেলো….
একমুঠো অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করতে থাকা এক জোড়া চোখ-
আমার মায়ের এমন চোখ আমি কোনদিন দেখিনি।
একটা আই সি ইউ যদি পাওয়া যায় কিংবা এক সিলিন্ডার অক্সিজেন,
তাই সিএমসি’র ফিনাইল মাখা ফ্লোরে গড়াগড়ি করে কেঁদেছি আমি-
মেডিকেল ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট অপর্ণা সেন
মা মৃত সুচিত্রা সেন
বাবা মৃণাল সেন।

আমি অপর্ণা সেন-
দু’দিন পর থেকেই দুই নম্বর গেটের একটা ছ’তলা বিল্ডিংয়ে চার তলার বাসাটায় আইসোলেশনে থাকি।

অক্সিমিটারে অক্সিজেন স্যাচুরেশনের ওঠানামা,
চোখের সামনে ইসিজি’তে একটা সোজা দাগ-
পরদিনই মা,
মানুষ থেকে হয়ে গেলো আইইডিসিয়ার থেকে উচ্চারিত সংখ্যায়,
“গত চব্বিশ ঘন্টায় করোনায় মৃতের সংখ্যা…..”
আচ্ছা,
মানুষ এতো সহজেই সংখ্যা হয়!

যেদিন মা মারা গেলো,
সবাই বললো,
“মা নেই তাতে কি, আমরা তো আছি?”
দু’দিন পর-
আইসোলেশন!!!
হা হা হা,
আমি, অপর্ণা সেন, আমার হাসি পায় রোজ-
চৌদ্দ দিন ধরে জানলায় দাঁড়কাক-রোদ-বৃষ্টি আর বাবা মৃণাল সেন ছাড়া মানুষ দেখিনি আর!
একে একে খুলে যাচ্ছে মুখোশ-
রোদ উড়ে যাচ্ছে দাঁড়কাকের ঠোঁটে;
আমি, অপর্ণা সেন জানি, বনলতা সেনের চুলের মতো রাত নামবে দ্রুতই!!!

আর,
আমি অপর্ণা সেন-
বাবা মৃণাল সেন।
দু’জন আজকাল দুটো আলাদা রুমে থাকি।
বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারিনা,
মাতৃশোক আর স্ত্রীশোক তীব্র আঘাত করলো যাকে-
তার চোখ কি স্বাভাবিক হয় আদৌ?

রাইমা’র সাথে ইদানিং কথা হয় ভিডিও কলে।
আমার আর বাবার করোনা ধরা পড়ার পরদিন পাঠিয়ে দিলাম তাকে আত্মীয়ের বাসায়।
রাইমা সেন, আমার ছোট বোন।
এ বছর দশে পড়লো….
রাইমা কাঁদে রোজ-
আমি অভয় দিই।
বাবা কাঁদে রোজ-
আমি অভয় দিই।
আমি কাঁদতে পারিনা
স্তম্ভিতদের কাঁদার সৌভাগ্য থাকেনা।

আমি অপর্ণা সেন,
মা সুচিত্রা সেনের মারা যাওয়ার পরদিন থেকেই কাঁদার সুযোগ পাইনি।
ইদানিং ভালো থাকার চেয়ে বেঁচে থাকা’কে বড় দামী মনে হয়!!!
রোজ গরম বাষ্প টেনে নিই
লেবু খেতে খেতে জিভ বিস্বাদ –
গার্গল করি;
আদাজল, মধু, রঙ চা-
যতো টোটকা সব….
সব!!!

মায়ের মৃত মুখ চোখে ভাসেনা
শুধু গন্ধ পাই;
দু’সপ্তাহ আগেই হঠাৎ বুড়িয়ে যাওয়া –
আমি অপর্ণা সেন।

বাবার শরীর ভালো নেই।
দুশ্চিন্তাটা তাকে নিয়েই।

আমি ইদানিং বাঁচবার স্বপ্ন দেখি; বাবাকেও দেখাই!!!
মা যদি বেঁচে থাকতেন; দেখাতাম তাকেও…

ইদানিং, আমি মৃত্যুকে ভয় পাইনা, জানেন?
খুব কাছ থেকে মৃত্যু ছুঁয়ে ফেললে বুঝি মৃত্যুভয় দূর হয়!

আইসোলেশনে থাকি।
ফেসবুকে মৃত্যুসংবাদ দেখে আর আগের মতো আঁতকে উঠিনা-
সংবাদগুলো হেঁটে সিড়ি বেয়ে উঠে এসেছে আমার ঘরে….

এ বড় নিষ্ঠুর যাপন।
এ নিদারুণ নিস্তব্ধ সময়-
যেন, একাকী মহাসমুদ্রের নির্জনতায় আর্নেস্টের হাহাকার!

তবুও মৃত্যু নয়; বেঁচে থাকার তীব্র তৃষ্ণা নিয়ে ধুঁকতে থাকা-
আমি অপর্ণা সেন।
মা মৃত সুচিত্রা সেন।
বাবা মৃণাল সেন।

আমরা তিনজনই পৃথিবীর তিনটি কক্ষে আইসোলেশনে থাকি।

guest
0 Comments
Newest
Oldest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments