পৃথিবীও বদলায় রহস্যের ঘেরাটোপে
বদলায় মানুষের মুখ!
বদলে যায় মায়ামগ্ন জীবন নিয়তির
নিয়মে,শ্রীপৃথিবী জানে—
বদলে বদলে অনন্তকাল
বেঁচে থাকাটাই মৃত্যুর তূণের ছিলায়
মৃত্যুময় জীবন এই তো—
বিধাতার বেঁধে দেয়া নিয়তিবৃত্ত
অপ্রতিরোধ্য বিদেহী গীতিকা
আরশি নদী বয়ে যায় স্রোতের বিপরীতে
বিরহের নাগরদোলা যেন
মেতে ওঠে অন্তহীন জীবনের প্রপাতে
জীবনটাই তো আহা!
পরাজিত মোহের মন্দাক্রান্তা সৌকর্য
মানুষও বদলায়
বদলায় প্রতিশ্রুতি মুখঃনিসৃত
কিংবা—প্রতিশ্রুতি নিঃসৃত
ভালোবাসার মন্ত্রজাল
আসলে কে করে কার এই পৃথিবীতে
দেখভাল!
মানুষ কী জানে, মানুষের জীবনটা কী!
জীবন তো—অ্যান্ড্রয়েড ফোনের
সাদৃশ্য কীপ্যাড
বস্তুত শরীরি জীবন!
চক্রজালে আঁকড়ে থাকা অমিত
দিকচক্রবালে পড়ে থাকা ভাঙা শানকি…।
‘পৃথিবী বদলায়, বদলায় মানুষের মুখ‘ একটি গভীর অন্তর্দর্শনমূলক রচনা, যেখানে পৃথিবী, মানুষ, জীবন এবং তাদের পরিবর্তনের অনিবার্যতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কবি এখানে আমাদের অস্তিত্ব এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনশীল প্রকৃতির পাশাপাশি, মানবজীবনের নিস্তরঙ্গ প্রকৃতিকে এক গভীর ভাবনামগ্ন রূপে উপস্থাপন করেছেন।
পৃথিবীও বদলায় রহস্যের ঘেরাটোপে / বদলায় মানুষের মুখ!—এই লাইনগুলো পৃথিবী এবং মানুষের পরিবর্তনশীলতাকে প্রতিফলিত করে। এখানে কবি পৃথিবীকে এক অব্যক্ত রহস্যের ঘেরাটোপে বেঁধেছেন এবং মানুষের মুখের বদলে যাওয়ার বিষয়টিকে তুলনা করেছেন পৃথিবীর সঙ্গে। পৃথিবী যেমন নিজস্ব নিয়মে বদলে যায়, তেমনি মানুষও নিজেদের নিয়মে এবং নিয়তির বাধ্যবাধকতায় পরিবর্তিত হয়। পৃথিবী এবং মানুষের পরিবর্তনশীলতা যেন মানব জীবনের ক্ষণস্থায়ী ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে।
বেঁচে থাকাটাই মৃত্যুর তূণের ছিলায় /মৃত্যুময় জীবন এই তো— / বিধাতার বেঁধে দেয়া নিয়তিবৃত্ত—এই অংশে কবি জীবনের অন্তর্নিহিত বিষাদময়তা এবং নিয়তির প্রতি আত্মসমর্পণ প্রকাশ করেছেন। বেঁচে থাকা এবং মৃত্যু এখানে সমান্তরালে চলে; জীবনের পথচলা যেন এক তীরের মতো যার শেষ গন্তব্য মৃত্যু। বিধাতার বেঁধে দেওয়া নিয়তিবৃত্তে জীবনের গতি বাধাগ্রস্ত এবং অবধারিত। এই নিয়তির খেলা মানুষের অস্তিত্বের গভীরে প্রভাব ফেলে এবং মানুষকে তার সীমাবদ্ধতার অনুভূতি দেয়।
বিরহের নাগরদোলা যেন / মেতে ওঠে অন্তহীন জীবনের প্রপাতে—বিরহকে কবি নাগরদোলার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা একঘেয়ে ঘুরে চলা জীবনের রূপক। বিরহ এবং দুঃখ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আমাদের অন্তহীনভাবে অনিশ্চিত পথে ঘোরাতে থাকে। পরাজিত মোহের মন্দাক্রান্তা সৌকর্য লাইনটি জীবনের সৌন্দর্য এবং মোহের পরাজিত রূপকে তুলে ধরেছে, যেখানে মানুষ পরিণামে জীবনের আকর্ষণ থেকে বিযুক্ত হতে থাকে।
মানুষও বদলায় / বদলায় প্রতিশ্রুতি মুখঃনিসৃত / কিংবা—প্রতিশ্রুতি নিঃসৃত / ভালোবাসার মন্ত্রজাল —এই লাইনগুলোতে কবি মানুষের পরিবর্তনশীল প্রকৃতি এবং তাদের প্রতিশ্রুতির অনিশ্চয়তাকে প্রকাশ করেছেন। মানুষের মুখ থেকে নিঃসৃত প্রতিশ্রুতি এবং ভালোবাসা পরিবর্তনশীল, যা জীবনের অনিশ্চয়তার একটি বড় অংশ হিসেবে উপস্থিত হয়। এই পরিবর্তনশীলতা এবং অনিশ্চয়তা ভালোবাসাকে এক ধোঁকাময় অনুভূতি হিসেবে তুলে ধরে, যেখানে স্থায়ীত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
জীবন তো—অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাদৃশ্য কীপ্যাড / বস্তুত শরীরি জীবন!—এখানে কবি আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে জীবনের তুলনা করেছেন। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের কীপ্যাডের মতো জীবন আমাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে বন্দি, যেখানে নিয়ন্ত্রিত এবং নির্ধারিত পথে চলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এখানে জীবনের ক্ষণস্থায়ীতা এবং প্রাত্যহিকতা প্রযুক্তিগত দৃষ্টিতে উপস্থাপিত হয়েছে, যা আধুনিক জীবনের বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। দিকচক্রবালে পড়ে থাকা ভাঙা শানকি লাইনটি জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতি এবং মানবজীবনের অমূল্য বর্জিত অংশগুলোর প্রতীক।
কবিতাটি অত্যন্ত গভীরভাবে মানবজীবনের অস্থায়িত্ব, ভালোবাসার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং নিয়তির প্রতি আত্মসমর্পণের চিত্র তুলে ধরে। কবি এখানে পৃথিবী এবং মানুষের পরিবর্তনশীলতাকে পরম সত্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে জীবন শুধুই এক আংশিক যাত্রা এবং নিয়তির একটি বন্ধন।
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালীর পৃথিবী বদলায়, বদলায় মানুষের মুখ’ কবিতাটি আমাদের জীবন এবং অস্তিত্বের রূপান্তরের চিরন্তন চক্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কবি এই কবিতার মাধ্যমে পাঠককে জীবনের অন্তর্নিহিত সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন এবং এই পরিবর্তনশীল জীবনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গভীর বোধ ও অন্তর্দর্শনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কবিতাটি আমাদের জীবনের অস্থায়িত্ব এবং নিয়তির প্রতীক হিসেবে অনন্য গভীরতা বহন করে।
আলতাব হোসেন
সম্পাদক: আমাদের সুজানগর
চমৎকার কবিতা