কেবল তুমিই দেখ না
অন্ধকারের ভেতরকার প্রগাঢ় বেদনা
সেও তো প্রহরের অনুমিত দুঃখ
কুহক রাত্রির বেদনা এখন জোছনার তরজমায়
শুধুই কল্পনার পূরাণ
কুয়াশাগাহনে দূরের নদীতে
ঢেউ ভেসে যায় পারদের মতো
আর—
ভোরই গোধূলি পেরুতে
অপেক্ষায় থেকে থেকে নিয়ড়ে
টেনে নেয় অন্ধকারের নির্জনতা…
কবি মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালীর প্রহরের অনুমিত দুঃখ কবিতাটি একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও ভাবনাসঞ্চারী সৃষ্টি, যেখানে কবি অন্ধকার, দুঃখ, কল্পনা এবং নীরবতার মাধ্যমে সময় এবং যন্ত্রণা তুলে ধরেছেন। এই কবিতায় তিনি দৈনন্দিন জীবনের প্রায় অনিবার্য দুঃখ ও বিষণ্ণতা, সময়ের নীরব প্রবাহ এবং তা থেকে উদ্ভূত অনুভূতিগুলোর এক অনন্য রূপক গড়ে তুলেছেন।
কেবল তুমিই দেখ না / অন্ধকারের ভেতরকার প্রগাঢ় বেদনা—কবিতার শুরুতেই কবি এক প্রগাঢ় বেদনার কথা বলেছেন, যা অন্ধকারের সাথে সম্পর্কিত। অন্ধকার এখানে দুঃখ এবং নির্জনতার প্রতীক, যা সময়ের প্রবাহের সাথে আসা এবং চলে যাওয়া প্রহরের মতো নিয়মিত। এই দুঃখ অনুমিত, কারণ এটি প্রহরের মতোই অনিবার্য; সময়ের পরিবর্তনের মতো দুঃখও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কুহক রাত্রির বেদনা এখন জোছনার তরজমায়—এই লাইনটি এক রহস্যময় এবং মায়াময় চিত্র তৈরি করে। কুহক বা মায়ার রাত, যা অস্পষ্ট এবং রহস্যে ঘেরা, সেই রাতের বেদনা জোছনার আলোর মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে জোছনা হলো কল্পনার প্রতীক, যা গভীর বেদনার তীব্রতাকে এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে রূপান্তরিত করে। কবি এই ভাবনাকে ‘কল্পনার পূরাণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা জীবনের দুঃখকে এক ধরনের মিথ বা গল্পে পরিণত করে।
কুয়াশাগাহনে দূরের নদীতে / ঢেউ ভেসে যায় পারদের মতো—এই লাইনগুলো এক দুর্বোধ্য এবং রহস্যময় চিত্র তৈরি করে। কুয়াশা এবং নদী এখানে জীবনের অনিশ্চয়তার প্রতীক। ঢেউয়ের পারদের মতো ভেসে যাওয়া একধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার প্রতীক, যা আমাদের মনোভাবের ওঠা-পড়া এবং আবেগের গতি নির্দেশ করে।
ভোরই গোধূলি পেরুতে / অপেক্ষায় থেকে থেকে নিয়ড়ে / টেনে নেয় অন্ধকারের নির্জনতা—কবিতার সমাপ্তি অংশে কবি এক মনস্তাত্ত্বিক চিত্র তৈরি করেছেন যেখানে ভোর এবং গোধূলি পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। গোধূলির বেলা যেন রাতকে বিদায় জানায়, আবার নতুন দিনের প্রারম্ভে ভোরও অপেক্ষায় থাকে। সময়ের এই চক্র অন্ধকার ও নির্জনতার নির্দিষ্ট আভাস দেয় যা জীবনেও ঘটে।
কবিতার প্রতিটি শব্দ এবং চিত্রকল্প কবির চিন্তাশীলতাকে ফুটিয়ে তোলে। শব্দচয়নে গভীরতা এবং ভাষার নিপুণ ব্যবহার কবিতাটিকে এক বিশুদ্ধ কাব্যিক পরিবেশ দেয়। কবি অন্ধকার, কুয়াশা, নদী এবং ভোর-গোধূলির দৃশ্য দিয়ে জীবনের প্রায়শই অনুধাবিত না হওয়া দুঃখ এবং তার নির্জনতাকে চিত্রিত করেছেন।
প্রহরের অনুমিত দুঃখ কবিতাটি মূলত সময়ের সাথে প্রবাহিত দুঃখ এবং একাকিত্বের রূপক। মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী এই কবিতার মাধ্যমে আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক দুঃখ এবং মনের অন্তর্নিহিত বেদনার এক গভীর চিত্র তুলে ধরেছেন। কবি এ কবিতার মাধ্যমে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, দুঃখ এবং সময়ের চক্র জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কবিতাটি আমাদের প্ররোচিত করে ভাবতে—জীবনের প্রতিটি প্রহরই দুঃখ ও সৌন্দর্যের এক অনন্য মিশ্রণ, যা নির্জনতায় অন্তর্লীন থাকে।
আলতাব হোসেন